সোমবার, ০৬ অক্টোবর ২০২৫, ০৫:৩৪ পূর্বাহ্ন
ধর্ম ডেস্ক:
জানাজা সামনে রেখে ভাষণ দেওয়ার প্রচলন দিন দিন বাড়ছে। প্রায়ই দেখা যায়, সমাজের গুরুত্বপূর্ণ কারও লাশ সামনে রেখে দীর্ঘ সময় ধরে নানা স্তরের লোকজন পালা করে বক্তৃতা করে যাচ্ছেন। অথচ আমরা ভুলেই যাই, কারও মৃত্যু হলে গোসল দিয়ে কাফন পরিয়ে দ্রুত জানাজার নামাজ পড়ে দাফন করতে হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) নির্দেশ দিয়েছেন।
জানাজাপূর্ব বক্তৃতায় সাধারণত মৃত বক্তি ‘ভালো লোক’ ছিলেন, এমন কথাই ঘুরেফিরে উচ্চারিত হয়। ক্ষেত্রভেদে তা হয় ‘রাজনৈতিক বক্তৃতার মঞ্চ’। বিশাল বক্তৃতা পর্বের জন্য জানাজার নির্ধারিত সময় বিলম্বিত হয়। অথচ এভাবে রাজনৈতিক বক্তব্য প্রদানের জন্য জানাজার নামাজ প্রবর্তিত হয়নি। জানাজার সময় মৃতকে সামনে রেখে দীর্ঘ সময় ধরে এমন বক্তব্য দেওয়ার প্রথা শরিয়তসম্মত নয়।
আফসোসের কথা হলো, ইদানীং উলামা-মাশায়েখের লাশ সামনে নিয়েও এমনটি করা হচ্ছে। জানাজার নামাজের সময় বিলম্বিত হলে অনেকের সমস্যা হয়। বহু মানুষ বিরক্তবোধ করতে থাকেন। অনেকেই প্রয়োজনীয় কাজ রেখে অল্প সময়ের জন্য জানাজায় শরিক হতে আসেন। কিন্তু দীর্ঘ বক্তব্যের কারণে পেরেশানির শিকার হন। অথচ জানাজার নামাজের আগে পরিবারের পক্ষে একজন ও ইমাম সাহেবের ‘মৃত্যুচিন্তামূলক’ সংক্ষিপ্ত বক্তব্য হলে যথেষ্ট হয়ে যায়।
লাশ সামনে রেখে নবীজি (সা.) কী বলতেন?
নবী করিম (সা.) এর অভ্যাস ছিল কোনো জানাজা সামনে এলে জিজ্ঞেস করতেন তার ঋণ রয়েছে কি? যদি জবাব হতো ঋণ নেই। তাহলে জানাজা পড়িয়ে দিতেন। অন্যথায় পড়াতেন না। কোনো এক সাহাবির লাশ সামনে রেখে নবী করিম (সা.) প্রশ্ন করেছিলেন, তার কোনো ঋণ আছে কি না? জবাবে সাহাবিরা বলেছিলেন ঋণ রয়েছে। নবী করিম (সা.) বললেন, তোমরা তার জানাজার নামাজ পড়ে নাও, আমি তার ঋণ থাকাবস্থায় জানাজার নামাজ পড়াব না। সাহাবিরা বললেন, আমরা ঋণের জিম্মাদার হয়ে গেলাম। তখন নবী করিম (সা.) জানাজার নামাজ পড়ালেন। -সহিহ বোখারি : ২২৮৯
শরিয়তের নির্দেশনা
কোনো ব্যক্তি মারা গেলে শরিয়তের নির্দেশনা হলো- বিলম্ব না করে তাকে গোসল দেবে, কাফন পরাবে। অতঃপর জানাজা নামাজ পড়ে দ্রুত দাফন করে দেবে। একাধিক হাদিসে মৃত্যুর পর থেকে দাফন পর্যন্ত সব কাজ দ্রুত আঞ্জাম দেওয়ার কথা বলা হয়েছে এবং বিলম্ব করতে নিষেধ করা হয়েছে। আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) বলেন, আমি হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে বলতে শুনেছি, তোমাদের মধ্যে কোনো ব্যক্তি মারা গেলে তোমরা তাকে আটকে রেখো না। তাকে দ্রুত দাফন করে দিয়ো। -আল মুজামুল কাবির, তাবারানি : ১৩৬১৩
অন্য হাদিসে রয়েছে, ‘তিন কাজে বিলম্ব করতে নেই। সেগুলোর অন্যতম হলো- যখন জানাজার জন্য লাশ উপস্থিত করা হয়, তখন দেরি করতে নেই। ’হজরত আবু হুরায়রা (রা.)-এর সূত্রে বর্ণিত, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, তোমরা মৃত ব্যক্তির জানাজার খাটলি নিয়ে দ্রুতবেগে যাও (কবরস্থ করার জন্য)। কারণ, মৃত ব্যক্তি যদি নেককার হয় তাহলে তো তোমরা তাকে কল্যাণের নিকটবর্তী করে দিলে, আর যদি সে নেককার না হয় তাহলে এক অকল্যাণকে তোমাদের কাঁধ থেকে নামিয়ে দিলে। -সহিহ বোখারি : ১/১৭৬
উল্লিখিত হাদিসসমূহে মৃত্যুর পর বিলম্ব না করে কাফন, জানাজা দ্রুত সম্পন্ন করে তাড়াতাড়ি দাফন করে দেওয়ার তাকিদ করা হয়েছে। এ সংক্রান্ত দলিলের আলোকে ইসলামি স্কলাররা মৃতের গোসল, কাফন-দাফন ও জানাজা সংক্রান্ত যাবতীয় কাজ দ্রুত সম্পন্ন করাকে উত্তম বলেছেন এবং বিনা ওজরে বিলম্ব করাকে মাকরুহ বলেছেন।
অবশ্য জানাজা সামনে না রেখে অন্য সময় আগে-পরে ‘সবাই ব্যক্তিগতভাবে মাইয়েতের গুণাবলি বর্ণনা করতে চাইলে করা যায়। কেননা মুমিন বান্দারা এ পৃথিবীতে আল্লাহর জন্য সাক্ষীস্বরূপ।’ -মিশকাত : ১৬৬২, জানাজা অধ্যায়
এমনিভাবে মুসল্লিদের উপস্থিতির সুবিধার্থে মৃত ব্যক্তির ঋণ পরিশোধ সম্পর্কে ইমাম সাহেব কথা বলতে পারেন। হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর যুগে জানাজার আগে মৃত ব্যক্তির ঋণ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হতো। নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘মুমিনের আত্মা ঋণের কারণে ঝুলন্ত অবস্থায় থাকবে, জান্নাতে যেতে পারবে না।’ -জামে তিরমিজি
ভেবে দেখার আহ্বান
পৃথিবীর সব জায়গায়, সব আয়োজনে যত অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা, বিশৃঙ্খলা থাকুক না কেন জানাজার নামাজটা যাতে বিরক্তবোধ ছাড়াই বিশুদ্ধভাবে পুরোপুরি হক আদায়ে সম্পন্ন করা যায়, সে চেষ্টা করা উচিত। ইসলামি শরিয়তের নির্দেশনার প্রতি সবার যতœবান হওয়া উচিত। তাই স্বাভাবিক সময়ের ভেতরে মৃতের জানাজা-দাফনের প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়ে গেলে মৃতের অভিভাবক উপস্থিত লোকদের নিয়ে জানাজা পড়ে দ্রুত দাফন করে দেবে। এ সময়ের ভেতর কোনো আত্মীয়-স্বজন বা বিশেষ কোনো ব্যক্তির উপস্থিত হওয়া সম্ভব না হলে তার জন্য বিলম্ব করা সমীচীন হবে না। অবশ্য অভিভাবক নিজেই যদি দূরে অবস্থানের কারণে স্বাভাবিক সময়ের ভেতরে তার উপস্থিত হওয়া সম্ভব না হয়, সেক্ষেত্রে তার জন্য উচিত হলো, তার জন্য অপেক্ষা করতে না বলে দ্রুত দাফন করে দিতে বলা। এতে ইসলামি শরিয়তের হুকুমের প্রতি যথাযথ আমল হবে। কিন্তু অভিভাবক যদি তার জন্য অপেক্ষা করতে বলেন, তাহলে তার জন্য বিলম্ব করার অবকাশ রয়েছে। অবশ্য এক্ষেত্রেও এ পরিমাণ বিলম্ব করার অবকাশ নেই, যার কারণে লাশের মধ্যে পরিবর্তন হওয়ার আশঙ্কা হয়। আর দাফনে দীর্ঘ বিলম্বের উদ্দেশ্যে লাশের পরিবর্তন ও বিকৃতিরোধে লাশকে হিমাগারে রাখা, ফরমালিন মেডিসিন ইত্যাদি পচনরোধক ওষুধ দিয়ে রাখা জায়েজ নয়। বরং লাশের স্বাভাবিক অবস্থা পরিবর্তন হওয়ার আগেই দাফন করে দেওয়া জরুরি। এর অধিক বিলম্ব করা গোনাহ।
মৃতদেহ হিমাগারে রাখা, ফরমালিন-মেডিসিন ইত্যাদি দিয়ে রাখা সম্মান পরিপন্থী ও কষ্টদায়ক। অথচ মৃত ব্যক্তির সম্মান ও মর্যাদা রক্ষা করা জরুরি। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেছেন, কোনো মুমিন ব্যক্তিকে তার মৃত্যুর পর কষ্ট দেওয়া তেমনই যেমন জীবিত অবস্থায় তাকে কষ্ট দেওয়া। -ইবনে আবি শাইবা : ১১৯৯০
এ সংক্রান্ত হাদিসের ব্যাখ্যায় আল্লামা ইবনে হাজার (রহ.) বলেছেন, জীবিত ব্যক্তি যে সব বস্তু দ্বারা আরামবোধ করে মৃত ব্যক্তি তা দ্বারা আরামবোধ করে। ইবনে মালেক (রহ.) বলেছেন, মৃত ব্যক্তি কষ্টদায়ক বস্তু দ্বারা কষ্ট পায়। -মিরকাতুল মাফাতিহ : ৪/১৭০
তাই মৃত ব্যক্তিকে হিমাগারে রাখা মূলত তাকে কষ্ট দেওয়ারই নামান্তর। এসব কর্মকা- থেকে বিরত থাকা অপরিহার্য।
অনুরূপ লাশ জানাজা-দাফনের জন্য প্রস্তত হয়ে যাওয়ার পর সামাজিক, রাজনৈতিক বা দলীয় প্রথা পালনের উদ্দেশ্যে লাশকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন কর্মকা- করা যেমন লাশকে স্থানে স্থানে নিয়ে প্রদর্শন করা, শ্রদ্ধা নিবেদন করা, পুষ্পস্তবক অর্পণ করা, ভিডিও করা, লাশকে সামনে রেখে দীর্ঘ সময় ধরে জীবনালোচনা করা, বিভিন্নমুখী ভাষণ-বক্তৃতা দেওয়া ইত্যাদি সবই গর্হিত। এগুলোর মধ্যে জীবিত-মৃত কারোরই কোনো কল্যাণ নেই। এসব কর্মকা- পরিহার করা সবার জন্য জরুরি।
ভয়েস/আআ